শুক্রবার, ০৩ অক্টোবর ২০২৫, ১২:০৫ অপরাহ্ন

দৃষ্টি দিন:
সম্মানিত পাঠক, আপনাদের স্বাগত জানাচ্ছি। প্রতিমুহূর্তের সংবাদ জানতে ভিজিট করুন -www.coxsbazarvoice.com, আর নতুন নতুন ভিডিও পেতে সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের ইউটিউব চ্যানেল Cox's Bazar Voice. ফেসবুক পেজে লাইক দিয়ে শেয়ার করুন এবং কমেন্ট করুন। ধন্যবাদ।

সমাবর্তন প্রতি বছর অনুষ্ঠিত হোক

নাসরীন সুলতানা:
গত ১৮ ফেব্রুয়ারি যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে চতুর্থ সমাবর্তন অনুষ্ঠিত হয়। অন্যদিকে, ২৫ ফেব্রুয়ারি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত হয় ষষ্ঠ সমাবর্তন। বয়সের বিচারে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় তার যৌবন পেরিয়ে পূর্ণবয়স্ক, যার বয়স বাংলাদেশের বয়সের সমান। অন্যদিকে, যশোর বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় বয়সের দিক থেকে একেবারে নবীন। এ বছর চতুর্থ সমাবর্তনে যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় স্নাতক, স্নাতকোত্তর, এমফিল ও পিএইচডিপর্যায়ে ১ হাজার ৮৩৪ জন গ্র্যাজুয়েটকে সনদ দিয়ে, যার মধ্য থেকে বিভিন্ন শ্রেণিতে ৫৭ জন স্বর্ণপদক ও অ্যাওয়ার্ডপ্রাপ্ত হন। এর মধ্যে ২২ জন গ্র্যাজুয়েট চ্যান্সেলর স্বর্ণপদক, ২৬ জন ভাইস চ্যান্সেলর অ্যাওয়ার্ড এবং ৯ জন ডিন অ্যাওয়ার্ড পান (তথ্যসূত্র :themailbd.com, ফেব্রুয়ারি, ১৮, ২০২৩)। অন্যদিকে, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় আয়োজিত ষষ্ঠ সমাবর্তনে অংশগ্রহণ করেন ১৫ হাজার ২১৯ জন শিক্ষার্থী, যার মধ্য থেকে ১৬ জনকে বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে স্বর্ণপদক দেওয়া হয় (তথ্যসূত্র : ঢাকা পোস্ট, ২৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩)।

দেখা যায় যে, যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৬ বছরে চারবার সমাবর্তন অনুষ্ঠিত হয়েছে। বাংলাদেশের সমান বয়সী জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ৫২ বছরে সমাবর্তন অনুষ্ঠিত হয়েছে ছয়বার। অন্যদিকে শতবর্ষী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ২০২২ সালে ৫৩তম সমাবর্তনের আয়োজন করে। অর্থাৎ, বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নিয়মিতভাবে সমাবর্তন আয়োজনে ব্যর্থ। অথচ প্রতি বছরই ছাত্র ভর্তি করার সময় তাদের শিক্ষাজীবন শেষে সনদ প্রদানের আনুষ্ঠানিকতার বিষয়টি বিবেচনা করা উচিত ছিল। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম বর্ষে ছাত্র ভর্তি করার সময় হলগুলোতে কী সংখ্যক আসন শূন্য আছে, বিভাগগুলোর কী পরিমাণ ধারণক্ষমতা আছে ইত্যাদি বিষয়গুলো বিবেচনা করা হয়। প্রতি বছর বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে ছাত্রকল্যাণ ফান্ড এবং বিভাগ ছাত্র সংসদে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ জমা দেওয়া হয়। কিন্তু শিক্ষাদান এবং পরীক্ষা শেষে তাদের আনুষ্ঠানিকভাবে সনদ প্রদানের বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা হয় না। আমি অনুমান করতে পারছি এটি প্রায় বাংলাদেশের প্রতিটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল চিত্র। অথচ, সমাবর্তন তথা শিক্ষাজীবন শেষে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পর সনদপ্রাপ্তির আনুষ্ঠানিকতা ছাত্র মাত্রেই অধিকার। যেকোনো ট্রেনিং প্রোগ্রাম শেষেও একটি আনুষ্ঠানিক সনদ প্রদান অনুষ্ঠান এর আয়োজন করা হয়। অথচ কোটি কোটি টাকার বাজেটের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে এ আয়োজনের প্রস্তুতি নিতে সময় লাগে কয়েক বছর। অনেকেই এ সময়ের মধ্যে কর্মজীবনেও কয়েক বছর পার করে দেন, ফলে সনদপ্রাপ্তির আনন্দটা সময়মতো উপভোগ করতে না পেরে সে যেন ক্রমেই ম্লান হতে থাকে।

অনেকে যুক্তি দিয়ে থাকেন যে সমাবর্তন আয়োজন একটি ব্যয়বহুল প্রক্রিয়া। চার পাঁচ বছরের দীর্ঘ বিরতিতে সমাবর্তন আয়োজন একটি ব্যয়বহুল প্রক্রিয়া বৈকি। আর এ ব্যয়ের একটি বড় অংশ বরাদ্দ করা হয় ১০-১৫ হাজার গ্র্যাজুয়েটের ধারণক্ষমতা সম্পন্ন প্যান্ডেল তৈরি করতে। পত্রপত্রিকা মারফত জানতে পারলাম, এ বছর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ষষ্ঠ সমাবর্তনের প্যান্ডেল বাবদ খরচ হয়েছে ১ কোটি ৫৫ লাখ টাকা। বিশ্ববিদ্যালয় এবং গ্র্যাজুয়েট উভয়ের জন্যই এটা গলায় বিঁধা কাঁটার মতো। প্যান্ডেল ছাড়া সমাবর্তন আয়োজন সম্ভব নয়, আবার এত টাকার জোগান দেওয়াও কষ্টসাধ্য ব্যাপার। ফলে, স্বাভাবিকভাবেই এই অর্থ জোগানের চাপ গিয়ে পড়েছে রেজিস্ট্রেশন ফির ওপর।

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো খুব সহজেই এ সমস্যার সমাধান করতে পারে। প্রতি বছর প্রথম বর্ষে ছাত্র ভর্তি করার সময় বিভাগের ছাত্রকল্যাণ তহবিল, বিভাগের জন্য বরাদ্দ করা ফান্ডের মতো সমাবর্তন তথা শিক্ষাজীবন শেষে তাদের আনুষ্ঠানিকভাবে সনদ প্রদানের বিষয়টি মাথায় রেখে একটা অর্থ বরাদ্দ দিতে পারে। এটা অন্তর্ভুক্ত হতে পারে বিশ্ববিদ্যালয়ের বার্ষিক বাজেটে কিংবা শিক্ষা শেষে শিক্ষার্থীদের রেজিস্ট্রেশন ফির মাধ্যমে, যেমনটি এখন করা হচ্ছে। একইভাবে অনুষ্ঠান আয়োজন হতে পারে অডিটোরিয়াম বা কোনো হলরুমে। এতে করে প্রতি বছর অল্পসংখ্যক গ্র্যাজুয়েটের জন্য আয়োজন করতে হবে বলে সমাবর্তন আয়োজন করতে বিশ্ববিদ্যালয় কর্র্তৃপক্ষকে বেগ পেতে হবে না। আবার অন্যদিকে, একটা বিশাল অঙ্কের অর্থ অপচয় রোধ করা সম্ভব হবে।

সমাবর্তন গ্র্যাজুয়েটদের জন্য শিক্ষাজীবন শেষে কর্মজীবনে প্রবেশের এক মাইলফলক। সমাবর্তন বক্তা হিসেবে গ্র্যাজুয়েটদের সামনে এমন একজন ব্যক্তিকে আমন্ত্রণ জানানো হয়, যার জীবন থেকে গ্র্যাজুয়েটরা একটি সুন্দর এবং বাস্তবধর্মী দিকনির্দেশনা পাবেন। স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটিতে একবার সমাবর্তন বক্তা হিসেবে উপস্থিত ছিলেন টেকনোলজির জগতের অন্যতম পুরোধা অ্যাপলের প্রতিষ্ঠাতা স্টিভ জবস, যিনি তার বক্তব্যে তার জীবনের তিনটি ঘটনা বর্ণনা করে গ্র্যাজুয়েটদের ভবিষ্যতে কী করণীয় সে বিষয়ে দিকনির্দেশনা দিয়েছেন, যা বিশ্বের কয়েকটি ভাষায় অনূদিত হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন একজন বিশিষ্ট ব্যক্তিকে বিশেষ সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি দিতে পারে। এতে সদ্য শিক্ষাজীবন সমাপ্তকারী গ্র্যাজুয়েটরা নিজেরা এ ধরনের সম্মানসূচক ডিগ্রি অর্জনের জন্য অনুপ্রাণিত হবেন, কর্মজীবনে সততা এবং নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করবেন, সমাজ এবং মানবতার কল্যাণে ভূমিকা রাখবেন। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই আমরা লক্ষ করি, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো জাতীয়তার গণ্ডি পেরিয়ে আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হতে পারেনি। কিংবা সমাবর্তন বক্তা নির্বাচন করার ক্ষেত্রে নিজেদের প্রচলিত কনভেনশনের বাইরে সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি। ফলে সমাবর্তন বক্তব্য গ্র্যাজুয়েটদের জন্য মূল আকর্ষণ হয়ে উঠতে পারে না।

সমাবর্তনের অন্যতম এক আকর্ষণ স্বর্ণপদক প্রদান। স্বর্ণপদক একদিকে যেমন একজন গ্র্যাজুয়েটের জন্য তার কঠোর পরিশ্রমের স্বীকৃতি, অন্যদিকে তেমনি এটি বর্তমান শিক্ষার্থীদের জন্য এক ধরনের প্রেরণা। তাই স্বর্ণপদক প্রদানের ক্ষেত্র এবং পরিধি বাড়ানো বিশ্ববিদ্যালয়ের পলিসির একটা অংশ হওয়া উচিত। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে স্বর্ণপদক প্রদান করা সম্ভব হয় না, কিংবা কয়েক বছরের শিক্ষার্থীদের মধ্য থেকে হয়তো একজন বা দুজন গ্র্যাজুয়েটকে ফলাফলের ভিত্তিতে নির্বাচন করা হয়। যেমন : এ বছর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে মোফাসসিল উদ্দিন আহমেদ স্বর্ণপদক ১১ জন গ্র্যাজুয়েটের মধ্য থেকে ১ জনকে প্রদান করার জন্য সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। কারণ স্বর্ণপদকের জন্য যে পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ আছে তাতে একজনকেই শুধু এই পদক দেওয়া যাবে। আমি ব্যক্তিগতভাবে এই সংবাদ পড়ার পর খুবই মর্মাহত হয়েছি। মোফাসসিল উদ্দিন আহমেদ স্বর্ণপদকপ্রাপ্তির যে শর্ত তাতে এই ১১ জনের ফলাফলই সেই শর্ত পূরণ করে। কিন্তু অর্থ সংকুলান করতে না পারার কারণে অনেকেই তাদের প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। এটা বিশ্ববিদ্যালয় এবং গ্র্যাজুয়েট উভয়ের জন্যই বিব্রতকর বটে।

এখন কথা হচ্ছে, স্বর্ণপদকের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থের জোগান আসবে কোথা থেকে? আমরা যদি একটু উন্নত দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর দিকে তাকাই তাহলে সহজেই এ সমস্যার সমাধান খুঁজে পাব। একটি বিশ্ববিদ্যালয় একজন গ্র্যাজুয়েটের জন্য দ্বিতীয় আঁতুড়ঘর। তাই বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে গ্র্যাজুয়েটের সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উচিত তার প্রতিটি গ্র্যাজুয়েটের সঙ্গে যোগাযোগের তথ্য লিপিবদ্ধ রাখা। এটা কঠিন কোনো কাজ নয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যালামনাইদের কাছে স্বর্ণপদকের ফান্ড গঠনের জন্য অনুরোধ করা যেতে পারে। আমি মাঝেমধ্যেই ইউনিভার্সিটি অব আলবার্টা থেকে ইমেইল পাই গ্র্যাজুয়েট দপাঠানো হয় যেখানে আমার পাঠানো ১০০ কিংবা ৫০ ডলার কী করে একজন মাস্টার্স কিংবা পিএইচডি স্টুডেন্টের টিউশন ফি প্রদানে সহায়ক হতে পারে তার বর্ণনা থাকে। কিন্তু আমাদের দেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে একজন অ্যালামনাইয়ের সম্পর্ক যেন বিশ্ববিদ্যালয় দিবস কিংবা পুনর্মিলনী অনুষ্ঠানে আগমন, র‌্যালি, স্মৃতিচারণ ইত্যাদির মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে। একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের তার বিশালসংখ্যক অ্যালামনাইকে তার সামর্থ্য অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফান্ড গঠনের জন্য কাজে লাগাতে পারে।

আমাদের দেশে সমাবর্তনকে কেন্দ্র করে বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে বিশাল এক কর্মযজ্ঞ, সমগ্র বিশ্ববিদ্যালয় যেন ব্যস্ত থাকে এই আয়োজনকে ঘিরে। এই প্র্যাকটিস থেকেও আমাদের বের হয়ে আসতে হবে। সমাবর্তন গ্র্যাজুয়েটদের অনুষ্ঠান, এটির আয়োজন যেন বর্তমান শিক্ষার্থীদের শিক্ষা এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাভাবিক কার্যক্রমে কোনো প্রভাব না ফেলে সে বিষয়টিও বিবেচনা করা উচিত।

লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, দর্শন বিভাগ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

Email: nsultana00ju@juniv.edu

সূত্র: দেশ রূপান্তর/ভয়েস/আআ

Please Share This Post in Your Social Media

© All rights reserved © 2023
Developed by : JM IT SOLUTION